Saturday, 17 July 2021

ইভ্যালি উত্তাল ঢেউকে আপনি সামলাবেন?

 গত দুইবছরে আমি কোথাও ইভ্যালি নিয়ে কোন কথা বলিনি, কিন্তু অসংখ্য লেখা পড়েছি, পজিটিভ, অধিকাংশই নেগেটিভ৷ ইভ্যালি থেকে আমি কখনও কোন কিছু কিনিনি, কেনার প্রয়োজন মনে করিনি। আমার ফিলোসফি হলো, যে জিনিস আমার প্রয়োজন সেটা যতো দামই হোক, আমি কিনবো, আর যেটার দরকার নেই সেটা মাগনা দিলেও নিবো না।

ইভ্যালি কনস্যুমারিজম বা ভোগবাদিতা উস্কে দেয়। ৫ হাজার টাকায় স্মার্ট টিভি, ৮ হাজার টাকায় ওয়াশিং মেশিন দেখলে কার না হাত উশখুশ করবে কেনার জন্য, যদিও সেটার দরকার হয়তো নেই। এজন্য আমি সজতনে ইভ্যালিকে এড়িয়ে চলেছি। কিন্তু একজন সচেতন ইন্ডাস্ট্রি স্টেইকহোল্ডার হিসেবে তাদের প্রতিটি মুভ, প্রতিটি অফার, প্রতিটি বক্তব্য, কাউন্টার বক্তব্য শোনার, পড়ার চেষ্টা করেছি।
বড়ভাই হাসানের মতে, ইভ্যালি হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে কোন পন্য অর্ধেক দামে পাওয়া যায় কিন্তু সেটার জন্য ৪/৫/৬ মাস অপেক্ষা করতে হয়। ইভ্যালিতে তিনি এমন পন্যই অর্ডার করেন যেটা আগামী ৪-৫ মাস না হলেও চলবে। তাৎক্ষণিক কোন পন্য দরকার হলে তিনি অন্য কোন চ্যানেলের দারস্থ হন। ইভ্যালির প্রায় সকল ক্রেতা আমার ধারণা এই মডেলে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে।
ইভ্যালি নিয়ে অনেক এনালিসিস, অনেক গবেষণা পড়েছি, আমার কাছে তাদের বিজনেস মডেল মনে হয়েছেঃ
• শুরুতে তারা ১০ টাকায় পেনড্রাইভ, ৫ টাকায় টিশার্ট টাইপ দিয়ে তাদের ক্যাম্পেইন শুরু করেছিল, উদ্দেশ্য ছিলো এ্যাডভার্টাইজমেন্ট বাবদ বরাদ্দকৃত টাকাটা গ্রাহকদেরকে দিয়ে ওয়ার্ড অফ মাউথের মাধ্যমে নতুন কিছু ক্লায়েন্ট বেস তৈরি করা। এই ক্যাম্পেইনগুলোর অভূতপূর্ব সাফল্য এবং গ্রাহকদের পিয়ার প্রেসারে তারা এই আর্থ শেকিং ডিস্কাউন্ট থেকে বের হতে পারেনি, কন্টিনিউ করে গেছে, এখনো করছে।
• এই হিউজ ডিসকাউন্ট তারা কিভাবে দিচ্ছে, খুবই সহজ, একজনের টাকা আরেকজনকে দিয়ে। নতুন অর্ডার, সাপ্লায়ারের ক্রেডিট সব মিলিয়ে তারা একটা বাবল ক্রিয়েট করতে পেরেছে।
• পুরো প্রসেসটা তারা চালিয়ে যাচ্ছে নতুন একটি দিনের অপেক্ষায়, একটা ভালো ইনভেস্টমেন্ট। ১-২ হাজার কোটি টাকার একটা ইনভেস্টমেন্ট পেলে তারা ধার দেনা, পেন্ডিং অর্ডার থেকে শুরু করে সব কিছু শোধ করে দিতে পারবে, মাঝখান থেকে ৮-১০ টা টেক বিজনেস, ৫০-৬০ লাখ গ্রাহক, ব্রান্ড ভ্যালু- এইগুলো এ্যাসেট হিসেবে থাকবে।
মোটাদাগে এই হলো ইভ্যালি নিয়ে আমার বুঝ। ইভ্যালিকে যদি আপনি ট্রেডিশনাল বিজনেসের চশমা দিয়ে দেখেন তবে অনেক ফাঁকফোকড় ধরা পড়বে। আবার যদি নিও বিজনেস সম্বন্ধে যারা ধারণা রাখেন তাহলে দেখবেন অনেক উদাহরণ পাবেন বিশ্বজুড়েই এমন।
একটা টেকবেসড ই-কমার্স কোম্পানির জন্য দুই বছর খুবই স্বল্প সময়। এই সময় সবাই ক্যাশ বার্নিং স্টেজে থাকে, এখন এই সময়ে যদি আপনি তাদের ব্যালেন্স শীট নিয়ে টান দেন এ্যাসেট-লায়াবিলিটির পার্থক্য অনেক বেশিই মনে হবে। এ্যামাজন কত বছর পর রিসেন্টলি প্রফিটে এসেছে, উবার কিছুদিন আগে স্টক মার্কেটে এসেছে এই ঘোষণা দিয়ে, আমরা জানিনা আমরা কবে প্রফিটে আসবো, রকমারি এই সেদিন প্রফিটে আসলো, চালডাল,খাসফুড, পারমিদা- জানামতে সবাই স্ট্রাগল করছে প্রফিট নিয়ে। আমার নিজের ছোট্ট আহলান থেকে জানি এইসব ব্যবসা থেকে প্রফিট বের করা কতটা কষ্ট।
আর প্রফিট খুবই সেনসিটিভ একটা টার্ম। কেউ যদি বলে আমি খুব লাভে আছি, কাস্টমাররা নিজেকে ডিপ্রাইভড ও লস্ট মনে করে। কেউই তাদের প্রফিটিবিলিটির কথা পাবলিকলি শেয়ার করতে চায় না, সেটা মুদির দোকান হোক আর ইভ্যালি হোক। সব সেলার যখন গ্রাহকের কাছে বলতে থাকে, ভাই একদম লাভ করি নাই, সেখানে ইভ্যালিকে স্ট্রাগল করতে হচ্ছে নিজেকে প্রফিটেবল প্রমাণ করার জন্য। দুনিয়াটা বড়ই আজিব জায়গা!!
ইভ্যালিকে যারা এমএলএম বলছেন তাদের নিয়ে কোন কথা নেই, তাদের জ্ঞানের বড়ই অভাব, এটা নিয়ে লিখতেও রুচিতে বাঁধে। আর যারা পঞ্জি স্কিম বলছেন তাদের নিয়ে দুইটা কথা আছে। পঞ্জি স্কিম হলো একজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আরেকজনের টাকা পরিশোধ করা। এই স্কিম আমরা ছোট, বড় সবাই চালাই, বিশেষ করে ব্যবসায়ীরা। আমার কথাই বলি, আমি মধু বেচে ব্যাগের কাপড় কিনি, বেতনের টাকা পেয়ে আরেকজনের বেতন দেই, একজনের কাছ থেকে ধার করে আরেকজনের টাকা শোধ করি। জীবন মানেই পঞ্জি গেইম। আমি আর দারদা ভাই মিলে একটা ডেলিভারি কোম্পানি দেয়ার প্লান করেছিলাম, সেখানে হিসেব করে দেখেছি ১৫-২০ দিনের জন্য ভালো একটা এমাউন্ট সেই ব্যবসা থেকে বের করতে পারতাম যেটা আমরা আমাদের বা অন্য ব্যবসায়ীদের শর্ট-টার্ম ধার দিতে পারতাম। পুরো টাকাটাই কিন্তু অন্যের টাকা।
ব্যবসা মানেই পঞ্জি খেলা৷ কোন ব্যবসায়ীই টাকা বসিয়ে রাখতে চায় না। সাপ্লায়ারের কাছে দুইদিন পরে দিয়ে, কাস্টমারের কাছ থেকে দুইদিন আগে নিয়ে যতটা পারা যায় বাবল ক্রিয়েট করা। এই কাজটাই ইভ্যালি করেছে, করছে, একটু বড় স্কেলে, একটা বড় ইনভেস্টমেন্টের আশায়। এখন এটাকে যদি পঞ্জি বলেন তাহলে আপনার জ্ঞানের দৈন্যতা নিয়ে আমার করুণা হবে।
এই যে এখন স্টার্টাপ কালচার চলছে, স্টার্টাপের সবচেয়ে বড় সমস্যা কি জানেন, একটা স্টার্টাপ সাকসেসফুল হওয়া মানে প্যারালালি আরেকটা ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংস হওয়া। উবার সাকসেসফুল হওয়া মানে ট্যাক্সিওয়ালাদের স্ট্রাগল করতে হবে, চালডাল সফল হওয়া মানে মুদি দোকানদারদের বেচাকিনি কমে যাবে, ইভ্যালি সফল হওয়া মানে শোরুম ব্যবসায়ী, ব্যাংকার, ছোট ইকমার্স ক্ষতিগ্রস্ত হবে এটাই স্বাভাবিক। হারিকেন ইন্ডাস্ট্রির হাতে হারিকেন ধরে যাবে বলে চার্জার লাইটের অগ্রযাত্রা আমরা রুখে দিতে পারিনা।
এফটুসি (ফ্যাক্টরি টু কনস্যুমার) বা বাল্ক পারচেজ মডেল সফল হলে শোরুম ব্যবসায়ীরা ধরা খাবে, ছোট ইকম কম চলবে। আজকে ইভ্যালি দেশী প্রতিষ্ঠান, রাসেল ভাই গরীব মানুষ বলে সবাই মিলে চেপে ধরে হয়তো থামিয়ে দিতে পারবেন কিন্তু একের পর এক আসা সমুদ্রের কতগুলো উত্তাল ঢেউকে আপনি সামলাবেন? আজকে ইভ্যালি এসেছে কালকে এ্যামাজন আসবে, পিন্দোদো আসবে, ডিস্কাউন্ট দিয়ে ধ্বসায় দিবে, তখন পারবেন পাড়ার মাস্তানের মতো এরকম হ্যাডমগিরি দেখাতে?!?
কনস্যুমারের চাহিদা বুঝতে হবে, কনস্যুমার কমদামে পন্য চায়, কনস্যুমার আপনার শোরুমের এসির বিল দিতে চায় না, আপনি মডেল নাচাবেন তার চার্জ দিতে রাজি না, সে চাইবে কোথা থেকে কমে পাওয়া যায়। আজকে ইভ্যালির সাথে সাথে আরও অসংখ্য ডিসকাউন্ট বেসড ই-কমার্স প্লাটফর্ম দাঁড়িয়ে গেছে। ইভ্যালির সাথে সাথে এগুলোকেও হয়তো চেপে ধরবেন কিন্তু কনস্যুমারের শ্বাশত এই চাহিদা কি দাবিয়ে রাখতে পারবেন?!?
ইভ্যালির সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো, মানুষের এই কোর চাহিদার জায়গাটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া। ইভ্যালি যদি এযাত্রায় সফল হতে না-ও পারে, তাদের যদি থামিয়ে দেয়া হয়, তবুও এই বিজনেস মডেল থেমে যাবার নয়। হয় প্রোডিউসাররা নিজে এই মডেলে কাজ করবে, নয়তো কোন জায়ান্ট এসে এগিয়ে নিয়ে যাবে অনেকদূর। এই আমরাই গ্রামের কৃষক কেন টমেটোর দাম পায় না তা নিয়ে হাহুতাশ করি, আবার কেউ যখন সরাসরি কৃষকের থেকে পন্য নিয়ে গ্রাহকের ঘরে কমদামে পৌছে দেবার চেষ্টা করে তার কন্ঠরোধ করি। থার্ড পার্টি ব্যবসা, শোরুম ব্যবসা নিকট ভবিষ্যতে থাকবে না। যতদ্রুত আমরা এই পরিবর্তনকে মেনে নিবো, নিজের ব্যবসার ধরনকে পরিবর্তন করবো ততই লাভ। নাহলে হারিকেন ব্যবসায়ীর মতো হাতে হারিকেন ধরা ছাড়া উপায় থাকবে না।
ইভ্যালির জন্য শুভকামনা। ইভ্যালি টিকে থাকুক দেশের ই-কমার্সের জন্য, টিকে থাকুক তার ৫০-৬০ লাখ গ্রাহকের জন্য, অসংখ্য সেলারের জন্য, থাউজেন্ডস অফ রাইডারের জন্য। এতগুলো লোকের স্বার্থের দিকে না তাকিয়ে নিজের হীন স্বার্থের জন্য যারা ইভ্যালির বিরুদ্ধে লেগেছেন তাদের জন্য একরাশ ঘৃণা!

No comments:

Post a Comment