Friday 2 July 2021

সেলস নাকি ব্র্যান্ডিং

 তকাল জিগেস করেছিলাম, প্রডাক্ট সেলসের জন্য কি ব্র্যান্ডিংয়ের দরকার হয়? এর উত্তর লিখতে বস্লাম৷

বেশীরভাগ একাডেমিয়ানরা ব্র্যান্ডিংয়ের পক্ষে। অর্র্থাৎ, ব্র্যান্ডিং করলেই সেলস আসবে - এটা আদতে একটা কেতাবী সংজ্ঞা। এবং এই সংজ্ঞা দুনিয়ার সব দেশ ও জাতি - মতান্তরে দুনিয়ার সব বাজার ও তার কাস্টমারের জন্য প্রযোজ্য নয়।
অপরদিকে বেশীরভাগ কর্পোরেট প্রফেশনালসরা সেলসের পক্ষে। কোন দেশে ব্র্যান্ডিং করলেই সেলস আসবে সত্য (যেমনঃ আমেরিকান ও ইউরোপিয়ান দেশগুলো) - আবার কোন দেশে সেলসই মোদ্দা কথা, ব্র্যান্ডিংয়ের খুব একটা ভূমিকা সেলসে অনেক সময়ই দেখা যায় না (যেমনঃ ভারতীয় উপমহাদেশের রাষ্ট্রগুলো, বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে।)
এটা নিয়ে প্রচুর বাদানুবাদ হয়েছে। ব্র্যান্ডিংয়ের লোকেরা বলে - ব্র্যান্ডিং হলে সেলস এমনিতেই আসবে। আর সেলসের লোকেরা বলে, সেল ঠিকমতো করতে পারলে ব্র্যান্ডিংয়ের কোনই দরকার নাই। আবার কেপিআই মিট না হলে তারা পরস্পরকে নিয়ে ব্লেম গেম খেলে এমন নজিরও অসংখ্য রয়েছে!
আপনি যদি আমাকে এই প্রশ্ন করেন - তাহলে বলবো, এইটা এক কথায় উত্তর দেয়া সম্ভব না।
আমি বলবো - ইট ডিপেন্ডস!😄
এই ধরনের উত্তর শুনলে অনেকেই বিরক্ত হবেন, ভাববেন নিউট্রাল উত্তর দিয়ে হয়তো ব্র্যান্ডিং আর সেলস - উভয় পক্ষের কারোই বিরাগভাজন না হবার চেষ্টা করছি।
হাহা, ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। আসলে এটা নির্ভর করবে মার্কেট, প্রডাক্ট, কোম্পানির ভিশন-মিশন ইত্যাদির উপর! যেমনঃ কোন মার্কেটে আমি পন্যটা বাজারজাত করছি, সেখানকার কাস্টমার ডেমোগ্রাফিক কি, কাস্টমারদের বায়িং হেবিট কি ধরনের, কাষ্টমার বায়িং ডিসিশান কিভাবে নেয় - ইত্যাদি এনালাইসিস না করে হুট করে একটা কেতাবি সংজ্ঞা বলে দিলেই হবে না।
একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই।
এই দেশের প্রায় ৭০% ক্রেতা বায়িং ডিসিশান নেয় পুশ সেলিংয়ের কারণে। বাকী ৩০% ক্রেতা কাউন্টার সেলিংয়ের কাস্টমার।
কাউন্টার সেলিং হলো - আপনি আগে থেকেই একটা পন্য কিনবেন বলে মনস্থির করে দোকানে গিয়ে সেটা কিনছেন। এবং আপনি এতটাই ডিটারমাইন্ড যে, পন্যটি দোকানের স্টকে না থাকলেও আপনি অন্য কোন প্রডাক্ট কিনেন না। মানে দোকানের কাউন্টার থেকে যেটা কিনে নিয়ে আসেন - সেটাই কাউন্টার সেলিং! একই কারণে, প্রেসক্রিপশন ছাড়া যে সমস্ত মেডিসিন কেনা যায় - তাকে এক কথায় ’ওভার দ্য কাউন্টার ড্রাগ’ বলা হয়। যেমনঃ নাপা, প্যারাসিটামল।
পুশ সেলিং হলো - আপনি বিক্রেতার প্ররোচনায় বা সেলস পিচে পটে গিয়ে যে পন্য কিনেন, সে ধরনের বিক্রয় পদ্ধতিতে বলে পুশ সেলিং! মানে সেলকে পুশ করা হয়।
ডেটা বলছে, কাউন্টার সেলিংয়ের চাইতে পুশ সেলিংয়ের কাস্টমার দ্বিগুনেরও বেশী। তাহলে যদি একটা ব্র্যান্ড ডিসিশান নেয় যে, সে তার সেলস টার্গেট ফিলাপ করতে ব্র্যান্ডিংয়ের চাইতে পুশ সেলিংয়ে বেশী ইনভেস্ট করবে, তাহলে কি তাকে দোষ দেয়া যায়?
যেহেতু এই দেশের ৭০% কাস্টমারের বায়িং ডিসিশানকে সরাসরি ইনফ্লুয়েন্স করছে বিক্রেতারা, সেহেতু এই দেশের পুশ সেলিং মানে মোটা দাগে ট্রেড মার্কেটিংয়ে ইনভেস্ট করা! মানে সেলস এজেন্ট, পাড়ার মুদি দোকানদার - এদের কমিশন বাড়িয়ে দেন - এরাই চোখবুজে আপনার সেলস এনে দিবে। এরপর আপনি ব্র্যান্ডিং করলে ভালো, না করলেও সমস্যা নাই। সেলস কমবে না। কারণ আপনার সেলস ট্রেড মার্কেটিংয়ের উপর নির্ভরশীল! এটিএল/বিটিএল এর উপর নয়।
প্রশ্ন করতে পারেন, এমন একটা ব্র্যান্ডের নাম বলেন যার ব্র্যান্ড ভ্যালু ভালো, অথচ সেলস পড়তির দিকে।
এমন একটা না, কয়েকটার নাম বলছি। মিঃ কুকিজের বিস্কুট! ব্র্যান্ড ভ্যালু এখনো বেশ ভালো, অনেক কাস্টমারের TOMA এ আছে এই ব্র্যান্ড! কিন্তু সেল কিন্তু আগের চাইতে অনেক কম হয়। এরপর ধরেন তিব্বত সাবান। কিংবা স্যান্ডেলিনা বিউটি সোপ। অনেককে সাবানের কথা বল্লেই এর কথা বলবে, অথচ সেল কিন্তু অত আহামরি নয়। ছোট বেলায় আমাদের বাসায় প্রতি ঈদের দিন স্যান্ডেলিনার সাবান দিয়ে গোসল করে ঈদের জামাতে যেতাম। আর রেগুলার সোপ হিসেবে লাক্স ইউজ করা হতো।
তেমনি ভাইস ভার্সার উদাহরণও দেয়া যাবে। অর্থাৎ এমন ব্র্যান্ড, যার নাম তেমন কেউ শুনেনি, অথচ সেলস ভলিউমে সেরা!
এর উদাহরণ হতে পারে কাপড় ধোয়ার গুড়া সাবানের ভারতীয় ব্র্যান্ড ঘড়ি ডিটারজেন্ট! অনেকেই হয়তো এই ব্র্যান্ডটার নামও জানেন না! কারণ তারা এই দেশে তেমন কোন ব্র্যান্ডিং করেনি। বাংলাদেশে আমার কখনো এই ব্র্যান্ডের কোন বিজ্ঞাপন চোখে পড়েনি। অথচ ২০১৮ এর সেলস ডেটা অনুযায়ী বাংলাদেশে লন্ড্রি ডিটারজেন্ট ব্র্যান্ডের সেলস ভলিউমের দিক থেকে ঘড়ি রয়েছে ৩ নম্বরে। প্রথম ও ২য় যথাক্রমে রিন ও হুইল!
প্রশ্ন করতে পারেন, তাইলে সার্ফ এক্সেল গেলো কই? বাজারে তো সার্ফ এক্সেল এর ব্র্যান্ডিং সবচাইতে শক্তিশালী!
ঘটনা হলো, সার্ফ এক্সেলের টিজি আলাদা। জেট এরও। খুব লয়্যাল, আর প্রিমিয়াম এদের টিজি! জেট খুব সম্ভবত দেশী লন্ড্রি ডিটারজেন্টের ভেতর আমাদের দেশের সবচাইতে প্রিমিয়াম ব্র্যান্ড, দামও সবচাইতে বেশী! এই কারণেই আপনি এই ব্র্যান্ডটাকে পাড়ার মুদি দোকানে পাবেন না। পাবেন বড় বড় সুপারশপে! অথচ ছোট বেলায় আম্মুকে এটা দিয়েই কাপড় ধুতে দেখেছি। আমি যখন হাই স্কুলে পড়ি, তখন বিটিভিতে জেটের টিভিসি হরহামেশাই দেখা যেতো, অথচ এখন একেবারেই দেখা যায় না। সার্ফ এক্সেল, রিন, হুইল - তিনটারই আপনি মিনি প্যাক পাবেন কিন্তু আপনি কখনো জেটের মিনিপ্যাক খুঁজে পাবেন না। কারণ জেটের কাস্টমার কখনো মিনিপ্যাক কিনেও না। ফ্যামিলি প্যাক কিনে।
কল্লোল গ্রুপের প্রোডাক্ট তাদের গুনগত মানের জন্য খুব বিখ্যাত, মার্কেটে হিউজ ডিমান্ড, তবে কোন এক অদ্ভুত কারণে এরা ম্যাস মার্কেট থেকে সরে এসে নিজেদেরকে প্রিমিয়ামে প্লেস করেছে। এখন অল্প কিছু সিলেক্টেড জায়গা ছাড়া ওদের প্রোডাক্ট পাওয়া যায় না কোথাও! সুপারশপগুলোতে এদের রুম স্প্রে আর নিউট্রি-সি বেশ সুলভ, তবে FAY এর টিস্যু বক্স আমি শেষবার কোথায় দেখেছি মনে পড়ে না, সব জাগায় বসুন্ধরা টিস্যু!
আমি সম্প্রতি এক মজার তথ্য জানতে পেরেছি স্বপ্ন সুপারশপের উচ্চপদস্ত একজন নারী-অফিসারের কাছ থেকে। তিনি জানালেন - “স্যোশিও ইকোনমি এর C ক্লাসের কাস্টমারেরা সারা মাসের জন্য হুইল কিনে এবং সাথে কেনে সার্ফে এক্সেলের মিনি প্যাক, তারা তাদের দামী জামা কাপড় ধোয়ার সময় ৮০ ভাগ হুইলের সাথে ২০ ভাগ সার্ফ মেশায় যাতে ধোয়াটা ভালো হয়। A এবং B এর মানুষজন মেইনলি রিন কিনে। তবে ভালো জামা কাপড় সার্ফ এক্সেল দিয়ে ধোয়। খুব স্মল সেগমেন্ট প্রাইমারি ডিটারজেন্ট হিসাবে এক্সেল ব্যাবহার করে!” আমাদের বাসায় গত ৪/৫ বছর ধরে প্রাইমারি ডিটারজেন্ট হিসেবে এক্সেল ব্যবহার করা হয়।
আচ্ছা, ধান ভানতে শীবের গীত না গেয়ে প্রসংগে ফিরে আসি। বলছিলাম ঘড়ি ডিটারজেন্টের কথা, যা বাংলাদেশের কতজন কাস্টমারের টপ অব দ্য মাইন্ডে আছে, আমার সন্দেহ - অথচ সেলসে ৩ নম্বরে! অবশ্য ভারতে এর ব্র্যান্ডিং একেবারে মন্দ নয়। এদের ব্র্যান্ড এম্বাসেডর হচ্ছেন অমিতাভ বচ্চনের মতো ডাকসাইটে সিনিয়র সেলিব্রেটি!
কোম্পানির উদ্দেশ্য যদি থাকে প্রচুর রেভিনিউ জেনারেট করা, তাহলে উচিত হবে শুরুতেই ব্র্যান্ডিংয়ের পেছনে টাকা না খরচ করে শুরুতে বরং সেলস জেনারেট করার চেষ্টা করা - আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ছোট কোম্পানিগুলো বা নতুন ব্র্যান্ডগুলো তাই করে। ট্রেড মার্কেটিং করে দেদারসে! এতে করে তারা ভবিৎষতে ব্র্যান্ডিং খাতে বিনিয়োগ করার মতো যথেষ্ঠ পরিমান পয়সাও কামাই করে ফেলতে পারে।
অপরদিকে কোম্পানির উদ্দেশ্য যদি থাকে শক্ত ব্র্যান্ড গড়ে দশকের পর দশক বাজারে টিকে থাকার, তাহলে ব্র্যান্ডিংয়ের বিকল্প নেই। তখন সেলসে ফোকাস না করে কোম্পানির উচিত ব্র্যান্ডিংয়ে টাকা বার্ণ করা! এটা সাধারনত ঐ সব কোম্পানিই করে, যারা আগে থেকেই বিপুল পরিমান টাকা-পয়সা নিয়ে বাজারে নামে। যেমনঃ হালের আলিশা মার্ট! এরা শুরু থেকেই এটিএল/বিটিএল/ডিজিটাল করে ফাটায় ফেলতেছে, কিন্তু তাদের সেল তো এখন পযন্ত তদানুপাতিক হয়নি।
তবে তুমুল ব্র্যান্ডিং করলেই যে বাজারে দীর্ঘদিন টিকে থাকার নিয়তে আর্বিভূত হয়েছে, এমনটা সব কোম্পানি/পন্য/ব্র্যান্ডের ক্ষেত্রে নাও হতে পারে। আমি এর উদাহরণে কোন কোম্পানির নাম বলবো না। নাম বল্লে চাক্রি থাকবে না।😕
অপরদিকে, শুরুতে সেলসে ফোকাস রেখে ধীরে ধীরে নামকরা ব্র্যান্ড হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলেছে, এমন অনেক ব্র্যান্ড দেশে আছে! যেমনঃ হালিমা মোবাইল। কিছুদিন আগেই এই ব্র্যান্ড নিয়ে পিঅয়ার হল নিউজ মিডিয়াতে। আমি খোজঁ নিয়ে দেখি - এটি মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও টেকসই ব্র্যান্ড। রীতিমতো বিদেশী মোবাইল ব্র্যান্ডগুলোর সাথে পাল্লা দিচ্ছে, কিন্তু হাইলি এফরডেবল টু ম্যাস পিপল!
প্রাণ-আরএফএলকেও আমি এই কাতারে রাখতে চাই। প্রথমে তারা ব্র্যান্ড গড়ায় তেমন মনোযোগ দেয়নি। এখন দেশের অনেকগুলো নীশ বাজারে সেরা ব্র্যান্ডের আসন প্রাণ-আরএফএল দখল করে আছে। যেমনঃ প্লাস্টিক ওয়্যার! এবং প্রাণ খুব সম্ভবত বাংলাদেশের একমাত্র ব্র্যান্ড (বিস্কুট) যা ভারতের বাজারে ভারতীয় ব্র্যান্ডকে টেক্কা দিয়ে এগিয়ে গেছে। এটা মুটামুটি অবিশ্বাস্য একটা সফলতা আমাদের জন্য!
কারণ ইন্ডিয়ান বাজার অসম্ভব রকমের কম্পিটিটিভ বাজার, এবং তারা নিজেদের ব্র্যান্ডকেই বেশীরভাগ সময় প্রমোট করে। সেখানে ভীনদেশে ব্র্যান্ড হিসেবে প্রাণের বিস্কুট তাদের নিজেদের অনেক ব্র্যান্ডের চাইতেও জনপ্রিয় হয়ে গেছে! যা হোক, আমার বই নন-মার্কেটারদের জন্য মার্কেটিং তে আমি এ বিষয়ে বিশদ লিখেছি ইতোমধ্যে, সুতরাং এখানে বাহুল্য কলেবর বৃদ্ধির কোন মানে হয় না।
তবে আমার মতে সবচাইতে প্রমিত চর্চা হতে পারে, শুরুতে সেলস ও পরবর্তীতে ব্র্যান্ডিংয়ে ফোকাস করা। বড় কোম্পানিগুলোর প্র্যাকটিস দেখলেই বুঝতে পারবেন। ইউনিলিভার তাদের FMCG এর প্রডাক্টগুলোকে সারা বছরই প্রমোট করে, লাক্সকে একটা সময় কন্টিনিউয়াসলি হ্যামারিং করেছে টিজির কাছে। এখন কিন্তু অতটা দেখা যায় না। হয়তো কিছুদিন পর আবার শুরু করবে। অপরদিকে অনেক বড় বড় সাবান কে - যাদেরকে লাক্স থ্রেট মনে করেছে - রাতারাতি খেয়ে দিয়েছে।
আচ্ছা, এমন কোন উদাহরণ আছে - যার ব্র্যান্ডিং আর সেলস ভলিউম দুটোই সমান তালে উচ্চ শিখরে থাকার পরেও হারিয়ে গেছে? আছে। আমার আপাতত মনে পড়ছে এরোমেটিক হালাল সোপের কথা।
সে সময় এই সাবানের বিজ্ঞাপন দিয়ে ঢাকার বিলবোর্ড ছেয়ে ফেলেছিলো যমুনা গ্রুপ! আর সেলস ভলিউমের কথা যদি বলতে হয় - রাতারাতি ১৪% মার্কেট শেয়ার করায়ত্ত! মনে রাখতে হবে, সে সময়েও ইউনিলিভারের লাক্স বাজারে দুর্দন্ড প্রতাপে রাজত্ব করছিলো। সুতরাং, বাজারে নেমেই সম্পূর্ণ নতুন একটি ব্র্যান্ডের রাতারাতি ১৪% বাজার নিয়ে ফেলাটা কিন্তু চাট্টিখানা কথা ছিলো না।
তবে ব্র্যান্ডিং করে সেল নিয়ে আসার পরেও ব্র্যান্ডিং বন্ধ করা যাবে না। এটা একটা কন্টিনিউয়াস প্রসেস। যেমনঃ এরোমেটিক হালাল সাবানের সময় লাক্সের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিলো তাদের সাবানে যেহেতু প্রাণীর চর্বি আছে, সেহেতু মুসলমানরা ইউজ করতে পারবে না।
এমন অভিযোগ উঠার পরেও লাক্স তাদের সাবানের ব্র্যান্ডিংয়ে ইনভেস্ট করা বন্ধ তো করেইনি, উল্টা বাড়িয়ে দিয়েছিলো। তারা তাদের বিদেশী প্লান্ট থেকে লাক্স আমদানি করা শুরু করলো, যার ফলে তাদের খরচ বেড়ে গেলেও লস দিয়ে দেশের বাজারে আগের দামেই বিক্রি করতো। এরোমেটিকের হালাল সাবান তাদের এতটাই চাপে রেখেছিলো! কিন্তু দিন শেষে বিজয়ীর হাসিটা লাক্সই হেসেছে! একটা ইন্ডিয়ান কোম্পানির কাছে খোদ এরোমেটিক ব্র্যান্ডই বিক্রি হয়ে গেলো, পরে পুরোপুরি হারিয়ে গেলো। আর লাক্স হয়ে উঠলো সোপ ব্র্যান্ড থেকে সুপার ব্র্যান্ড!
একই কাজটা এ্যাপলও করে। এ্যাপলের কাস্টমার লয়ালটি এত বেশী শক্ত, তাদের ওয়ার্ড অব মাউথ মার্কেটিং এত দুর্দান্ত, তাদের আর্নড মিডিয়া এত এত বেশী, তারপরেও তাদের বাৎসরিক মার্কেটিং বাজেট থাকে বিলিয়ন ডলারের ঘরে। ২০১৫ সালে ছিলো ১.৮ বিলিয়ন ডলার! কারণ তারা জানে, ”মার্কেটিং ছাড়াই তো আইফোন বিক্রি করে কুলাতে পারছি না, তাইলে আর মার্কেটিং বাজেটের দরকার কি?” - এটা ভেবেছে তো মরেছে!
এই দেশের টোটাল গ্রোসারি বাজারের মাত্র ২% বিক্রি হয় ই-কমার্স (যেমনঃ চাল ডাল ডট কম) এবং মর্ডান ট্রেড (যেমনঃ অফলাইন গ্রোসারি শপ - স্বপ্ন, এগোরা, মিনা বাজার) এর মাধ্যমে। বাকী ৯৮% বিক্রি হয় খোলা বাজারে, কাচাঁ বাজারে, মুদি দোকানে। এই ২% যখন বেড়ে ১০% হবে, তখন এই দেশের টোটাল ব্র্যান্ড-মার্কেটিংয়ের দৃশ্যপট আমূল বদলে যাবে। বিজ্ঞাপনে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় চেঞ্জ আসবে।
যেমনঃ অস্ট্রেলিয়ার টোটাল গ্রোসারির ৬০% সে উপমহাদেশের মাত্র দুইটা গ্রোসারি ব্র্যান্ড (Woolworths & Coles) সার্ভ করে! যার বাৎসরিক মূল্য প্রায় ১০০ বিলিয়ন অজি ডলার! এ কারণেই ঐ দেশের মিডিয়া ও ডিজিটাল এজেন্সি তাদের গ্রোসারি বিজ্ঞাপন বানায় উলিস আর কোল্স কে টার্গেট করে। উলিস নির্ধারন করে অষ্ট্রেলিয়াতে গ্রোসারি ব্র্যান্ডিং কেমন হবে। এটা এতটাই চমকপ্রদ কেইসস্টাডি যে, এই বিষয়ে আলাদা করে একদিন বিস্তারিত লেখার ইচ্ছে আছে।
যা বলছিলাম, ২% এর কথা। আমাদের দেশের অনেক বড় ব্র্যান্ড তাদের নতুন কোন ভ্যারিয়েন্ট বাজারে ছাড়লে তারা সুপারশপের মাধ্যমে ঐ ২% কাস্টমারের কাছে ট্রায়াল-বায়িং করানোর চেষ্টা করে। আর ঐ ২% ক্রেতাদের বেশীরভাগই সুপারশপ থেকে ফ্রিতে বা হাই ডিসকাউন্টে ট্রায়াল-বায়িং করে পরবর্তীতে সেইটা কিনে কাচাঁ বাজার থেকে! এ কারণেই, কোম্পানিগুলোর মূল ফোকাস থাকে, ৯৮% মার্কেটের উপর, ২% এ তারা তখনই গোনায় ধরে যখন তাদের ট্রায়াল-সেলিংয়ের দরকার পড়ে!
May be an image of text that says 'সেলস নাকি ব্র্যান্ডিং- কোনটা বেশী দরকারী? প্রলয় হাসান'ব্র্যান্ড গড়ার কথা বল্লাম, এবার ব্র্যান্ড ভাংগার কথা বলি।
উপরে অলরেডি এরোমেটিকের কথা বলেছি। আরেকটা হলো, পেপস জেলের ঘটনা। ইউনিলিভার খুব মোটা অংকে বাংলাদেশের প্রথম জেল টুথপেষ্ট পেপস জেলকে কিনে নিয়ে বেমালুম হজম করে ফেলে, যাতে করে তাদের নিজস্ব ব্র্যান্ড পেপসোডেন্টকে বাজারে ছাড়তে কোন বেগ পেতে না হয়।
তেমনি, ২০০৯ সালে স্কয়ারের জুইঁ নারিকেল তেল কেনার জন্য স্কয়ার গ্রুপের এমডিকে ভারতীয় একটা প্রতিষ্ঠান প্রায় ৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার অফার করেছিলো। এমডি সাহেব আরো টাকা চাইলেন, এরপর তা ডাবল করে ১০ মিলিয়নে আনা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে উনি আর জুঁই ব্র্যান্ডকে বেচেন না, কারণ জুইঁ ছিলো তার আদরের নাতনীর নাম। নাতনীর নামেই নারিকেল তেলটাকে তিনি ব্র্যান্ডিং করেছিলেন। তাই, নাতনীর প্রতি ভালোবাসার কারণে নাতনীর নামটি তিনি টাকার লোভে বিক্রি করে দিতে পারেননি। আমি বাজি ধরে বলতে পারি, উনি যদি বিক্রি করে দিতেন তবে জুঁইয়ের পরিণতিও হতো এরোমেটিক হালাল সাবানের মতো।
জুইঁয়ের আগে ছিলো ”হাসঁ মার্কা” নারিকেল তেল। আমি যখন প্রাইমারিতে পড়তাম, তখন আমার নানীকে দেখতাম ”হাসঁ মার্কা” নারিকেল তেল প্রতিদিন গোসলের পর মাথায় দিয়ে চুল আচড়াতে। পরবর্তীতে বাজারে প্যারাসুট আর জুইঁয়ের ধাক্কায় অক্কা পেলো হাসঁ। একটা ব্যাপারে এই সমস্ত প্রডাক্টগুলোর দারুন মিল আছে। আর তা হলো, বিভিন্ন কারণে এদের ব্র্যান্ডিং বন্ধ করার পর থেকেই সবারই সেল কমতে কমতে শূণ্যের কোঠায় গিয়ে ঠেকেছিলো, যার ফলে কোম্পানি তাদের জনপ্রিয় পন্যগুলোকেও বাজার থেকে বিলুপ্ত করে দিতে বাধ্য হয়েছিলো।
এখন আপনারাই বলেন, সেলস > ব্র্যান্ডিং, নাকি ব্র্যান্ডিং > সেলস, নাকি উভয়ই?
সঠিক উত্তরটা শুরুতে বলেছিলাম। এত বড় পোষ্ট পড়ে হয়তো অনেকে ভুলে গেছেন, তাই আবারো বলছি।
ইট ডিপেন্ডস!

No comments:

Post a Comment